Globe Securities Ltd. | Post Details ;
25 Sep

বিনিয়োগের লক্ষ্য ঠিক করুন: পর্ব-০২

বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বর্তমান শেয়ার মার্কেটের সম্ভাবনা নিয়ে স্বল্প পরিসরে আপনাদের উপকারে আসে এমন তথ্য দেবার চেষ্টা করেছি।

পুঁজিবাজার হচ্ছে এমন একটি জায়গা যা আপনাকে আপনার পুঁজির বিপরীতে কত লাভ করবেন তাঁর নিশ্চয়তা না দিলেও পুঁজির সম্পূর্ণ অংশ যে লস করবেন তার খাঁটি নিশ্চয়তা দেয়, যদি না আপনার বিনিয়োগের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ছক বা প্ল্যান থাকে।

বিনিয়োগের ব্যাপারে ব্যক্তিভেদে আপনাদের প্ল্যানের ভিন্নতা থাকলেও যেসব সাধারণ বিষয় সবারই বিনিয়োগ ছকে থাকা উচিত তা নিয়ে আপনাদের আজ জানানো হবে।

পুঁজির উৎসঃ আপনার বিনিয়োগের মূলধনের উৎস অবশ্যই হাতে অলস টাকা আছে এরকম হতে হবে। ১ বছর পর আপনি বিয়ে করবেন বা জায়গা কিনবেন সেই টাকা যদি আর একটু বাড়ে সেই মনোভাব নিয়ে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে বলতে হবে ভাই আপনি নিজেই আপনার বিনিয়োগের শত্রু। ১ বছর পর দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপও হতে পারে; তখন আপনার পুঁজি নিয়ে টানাটানি পড়লে কি করবেন?

বিনিয়োগের লক্ষ্য ঠিক করাঃ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত তা নিয়ে অনেক নতুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই পরিষ্কার ধারণা থাকে না। সত্যি কথা বলতে কি এই মার্কেট নিয়ে বেসিক ধারণা ও প্রাথমিক জ্ঞান না রাখলে বিনিয়োগের লক্ষ্য কি হবে তা ঠিক করা কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে লক্ষ্যহীন হয়ে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ থেকে যে সুফল পেতে চান সেটা পাওয়া সম্ভব হবে না।

যখন শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করার কথা আপনার মাথায় আসবে তখন আপনি ভাবুন কি কারণে আপনি শেয়ার মার্কেটেই বিনিয়োগ করবেন এবং এখান থেকে কি পেতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ, আপনার বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য/উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। এই মার্কেট থেকে আপনি মাসিক নাকি বাৎসরিক মুনাফা করতে চান? কি পরিমাণ মুনাফা করতে চান? শুধু যে মুনাফা করবেন তা নয়, কি পরিমাণ লস একসেপ্ট করবেন সেটা ও ঠিক করতে হবে। যে মুনাফা পাবেন তা দিয়ে কি করবেন? সংসার চালাবেন? তাহলে শেয়ার মার্কেট থেকে দূরে থাকুন। এই রোলার-কোস্টার মার্কেট আপনার সংসার চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়।

তাহলে সঞ্চয়কে বাড়িয়ে আপনার কি লাভ বা এই মার্কেট থেকে যেই নীট মুনাফা করবেন তা দিয়ে আপনি কি করবেন? এই মুনাফা ব্যয়ের জায়গা হতে পারে ভবিষ্যতের প্রয়োজন হবে এমন কিছুতে কিংবা আপনার বিলাস দ্রব্যের জন্য!!! অর্থাৎ আপনার ভবিষ্যতে (৫/১০ বছর পর) প্রয়োজন হবে এমন খাতের জন্য খরচের টাকা আপনি এই মার্কেট থেকে বের করতে চাচ্ছেন কিংবা আপনার বিলাস দ্রব্যের খরচ আপনি আপনার সঞ্চয়ের মুনাফা থেকে করতে চাচ্ছেন। আবার এটাও হতে পারে যে, ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের থেকে আগামি ৫ বছর পরে যে লাভ পাবেন তা থেকেও আরও ২৫-৩০% বেশি গেইন করতে চাইছেন স্টক মার্কেটে ৫ বছর বিনিয়োগ করে।

তাই, আপনার বিনিয়োগের থেকে লাভবান হবার জন্যে অবশ্যই বিচক্ষণতার সাথে সময় উপযোগী লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।

কোন মেয়াদে বিনিয়োগ করা উচিতঃ এই বিষয়টি আপনার বিনিয়োগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১ বছর পর আপনি যে পরিমাণ মুনাফা করতে পারবেন ১০ বছর পরে নিশ্চয়ই তার থেকে বেশি পরিমাণে মুনাফা করবেন। আপনার বিনিয়োগ কৌশল নির্ভর করবে আপনি আপনার মূলধনকে কতদিন বিনিয়োগে রাখতে পারবেন তার উপর। স্বল্প-মেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী এবং দীর্ঘ-মেয়াদী এই তিন ধরণের মেয়াদে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে।

স্বল্প-মেয়াদী = ৩ বছরের কম
মধ্য-মেয়াদী = ৩-১০ বছর
দীর্ঘ-মেয়াদী = ১০ বছরের বেশি সময়

ঠিকঠাক ভাবে যত দীর্ঘ সময়ে বিনিয়োগ করা যায় ততই লাভের পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে থাকে।

আপনি কোন মেয়াদে বিনিয়োগ করবেন তা নির্ভর করে আপনার অলস সঞ্চয় কত বছর প্রয়োজনহীন থাকবে তার উপর। যেমন- আপনি যদি আপনার ২০-৩০ বছর পরের Retirement সময়ে স্বচ্ছল ও নির্বিঘ্নে থাকতে চান তাহলে দীর্ঘ-মেয়াদে বিনিয়োগের ব্যাপারে আপনার দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত নয়।

আসল কথা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আপনার কোন প্রয়োজনীয় বিষয় পূরণ করতে চাইছেন তার আনুমানিক সময় হিসেব করে সেই অনুযায়ী আপনার বিনিয়োগের সময় বা মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে।

পুঁজির বিপরীতে সর্বোচ্চ ঝুঁকির পরিমাণ নির্ণয়ঃ সাধারণত সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগের রিটার্ন বা লাভের পরিমাণ সবচেয়ে কম হয়। সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হচ্ছে ভালো ব্যাংক, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি। এইসব বিনিয়োগে পুঁজির নিরাপত্তা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের তুলনায় অনেকগুণ বেশি হলেও এদের থেকে রিটার্নের পরিমাণ বেশ কম হয়। আপনার পুঁজির বিপরীতে আয়ের পরিমাণও বাড়বে যখন আপনি ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে তাতে সফল হবেন। আসল কথা হচ্ছে, নিরাপদ বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লাভের তুলনায় আরও বেশি লাভ করতে চাইলে আপনাকে পুঁজির নিরাপত্তা কমাতে হবে। যত বেশি লাভ হবে তত বেশি পুঁজির নিরাপত্তা কমবে এটাই capital safety vs. profit এর মধ্যকার বিপরীত সম্পর্ক।

শেয়ার মার্কেটে পুঁজির নিরাপত্তা অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনায় কম আর লাভ করার সুযোগও একটু বেশি থাকে বলে এর মানে এই নয় যে, পুঁজির নিরাপত্তা ০% এ নামিয়ে লাভ করা জন্য একের পর এক ট্রেড করে যেতে হবে।

এই মার্কেটে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী যে কারণে লস করেন তা হল বিনিয়োগের বিপরীতে কতটুকু ঝুঁকি নিবেন তা ঠিক না করেই শেয়ার ক্রয় করে থাকেন। প্রায়ই দেখা যায়, স্বল্প সময়ে ভালো মুনাফার আশায় গুজবের পিছনে ছুটে বা স্মার্ট মানি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিনিয়োগকে এমন করুণ ও ভীতিকর অবস্থায় নিয়ে আসেন যে, রাতে ঘুমের মধ্যেও কিভাবে পুঁজি ফেরত পাবেন তা নিয়ে ভাবেন।

এই অল্প সময়ে বেশি মুনাফা করার রোগ নিয়ে একটু ভাবুন। এই রোগের পাল্লায় সবাই পড়ে। ধরে নেন, আপনিও পড়ে গেছেন, এখন কি করবেন?

দেখুন, এই প্যারার হেডিং হচ্ছে “পুঁজির বিপরীতে সর্বোচ্চ ঝুঁকির পরিমাণ নির্ণয়”। এর মানে হচ্ছে, আপনাকে বিনিয়োগ করার আগেই আপনি আপনার ট্রেডে কতটুকু ঝুঁকি বা লস নিবেন তা ঠিক করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ, স্টপলস টার্গেট সেট করে ফেলতে হবে।

স্টপলসের টার্গেট সাধারণত স্বল্পমেয়াদে ১০%, মধ্যমেয়াদে ২০% ও দীর্ঘমেয়াদে ২৫-৩০% করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদে আপনার ক্রয়কৃত শেয়ারের মূল্য ১০% কমে গেলে আপনি তা বিক্রি করে ১০% লস নিতে রাজি এর বেশি নয়।

কোন মেয়াদে কতটুকু লাভ করতে চান তা ঠিক করাঃ পুঁজির ঝুঁকি নিয়ে তো ভাবলেন এবার কতটুকু লাভ করতে চান তাও ভাবুন। এতে করে বিনিয়োগের আসল উদ্দেশ্য লাভ করার ব্যাপারে আপনার পরিষ্কার ধারণা থাকবে। যদি আপনি মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রে এই মেয়াদে বিনিয়োগ করলে মুনাফা আসলে তার কি পরিমাণ হয় হিসেব করে ফেলুন।

আমাদের দেশে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে ৬ বছর ১০ মাস থেকে ৭ বছর ৪ মাসে (মধ্যমেয়াদে) ন্যূনতম ১০হাজার টাকা দ্বিগুণের স্কিম আছে। এছাড়া কিছু কিছু ব্যাংকে ১০-১৪ বছরে (দীর্ঘমেয়াদে) বিনিয়োগ তিনগুণের স্কিমও রয়েছে। তাহলে, দেখতেই পারছেন পুঁজি দুই বা তিনগুণ রাতারাতি হয় না। শেয়ার মার্কেটে সময় নিয়ে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ৭-১৪ বছরে বিনিয়োগের তুলনায় পাঁচ-ছয় গুণ বেশি টাকা মুনাফা করা অসম্ভব নয়।

ভালো শেয়ার চেনার জন্য আপনাকে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস, টেকনিক্যাল এনালাইসিস এবং কখন বিনিয়োগ করবেন তা বোঝার জন্য মার্কেট সব ধরণের বিনিয়োগকারীদের সাইকোলজি, মার্কেট ট্রেন্ড বুঝতে ও শিখতে হবে।

আবার যদি স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১০% আর সর্বোচ্চ ২০% লাভের টার্গেট রাখুন। কোন কারণে যদি আপনার স্বল্পমেয়াদে মাসিক লাভের টার্গেট পূর্ণ না হয় তাহলে কিভাবে সেই পরিস্থিতি সামাল দিবেন তাও ভেবে রাখুন।

উপরের এই দীর্ঘ লেখাতে যেই ৫টি বিষয় উল্লেখ করা হল, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের পূর্বে অবশ্যই আপনাকে এগুলো নিয়ে ভেবে আপনার নিজের কাছেই এসব বিষয়ের পরিষ্কার উত্তর থাকতে হবে। তা আপনি প্রাইমারি শেয়ার ব্যবসা করুন অথবা সেকেন্ডারি। গৎবাঁধা ‘এইম ইন লাইফ’ কম্পোজিশন লিখে নাম্বার পাওয়া যাবে কিন্তু ‘ইনভেস্ট উইদাউট এইম’ হলে বিনিয়োগ রক্ষা করা যাবে না।

Comments